আফরোজা আক্তার ডিউ প্রায় একযুগের বেশী সময় ধরে কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুলে শিক্ষক হিসাবে চাকুরীরত। বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আফরোজা আক্তার ডিউকে সময়িক বরখাস্ত করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। চলতি অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখে কালেক্টরেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃনাল কান্তি সাহা স্বাক্ষরিত চিঠিতে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সহকারী প্রধান শিক্ষক আফরোজা আক্তার ডিউকে এই বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। যার স্মারক নং-কুঃ/কালেক্টরেট/স্কুঃকঃ/২০২৪.৪৮।কালেক্টরেট স্কুল সুত্রে জানা যায়, আফরোজা আক্তার ডিউ স্কুলে অনুপস্থিত থাকার কারণে সময়িক বরখাস্ত হওয়ার পত্রটি তার বাসার ঠিকানায় ডাকযোগে প্রেরণ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে বাড়ী না থাকায় তা স্কুলে ফেরৎ আসে।
যার ফলে মোবাইল ফোনে সময়িক বরখাস্ত হাওয়ার বিষয়টি আফরোজা আক্তার ডিউ জানানো হয়েছে। ঐ চিঠিতে সময়িক বরখাস্তে কারণ হিসাবে স্কুলে অনুপস্থিত, জাল সার্টিফিকেট এবং একাধিক মামলার বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে আফরোজা আক্তার ডিউ।এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আফরোজা আক্তার ডিউ স্কুলে শিক্ষকতার পাশা পাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলো। সে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। নিজের দলীয় পদ-পদবী ব্যবহার করার ফলে বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না।
স্কুলে না গিয়ে তাকে প্রায়সই রাজনৈতিক মিছিল মিটিং এ দেখা যেত। বছরের বেশীর ভাব সময়েই কুষ্টিয়া সহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত। যার ছবি তিনি তার ফেসবুকে পোষ্টও করতেন নিয়মিত। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার সাথে সাথে আফরোজা আক্তার ডিউ ও তার পরিবারের সদস্যরা গোপনে কুষ্টিয়া ছেড়ে আত্নগোপনে চলে যায়। সেই সাথে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয় এবং ফেসবুক একাউন্টও ডিএ্যাক্টিভেট করে দেয়। এদিকে একাধিক অভিযোগ এবং তার প্রমাণ থাকলেও তার বিরুদ্ধে ধীর গতিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। স্কুলের একাধিক শিক্ষকরে সাথে কথা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
রাজনৈতিক পরিচয় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পেতেন না।সবাই তাকে ভয় করে চলতেন। তার কথাই এই স্কুলে আইন হিসাবে বিবেচ্য হত। জাল সনদের বিষয়ে ঐ শিক্ষকরা আরো বলেন, এটি আমাদের জানা ছিলো না। আমরা বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। কিন্তু এত বড় মাপের একজন প্রতারকের বিরুদ্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে হতাশাও প্রকাশ করেন তারা।এদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মানববন্ধব করা সহ নানান অভিযোগ রিয়েছে তার বিরুদ্ধে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুর রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হয়। ঐ ঘটনায় কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক আবু সাঈদ হত্যার নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট করার কারণে সেই সকল শিক্ষকদের নানান ভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেন আফরোজা আক্তার ডিউ। বাধ্য হয়েই সেই পোষ্ট ডিলিট করে শিক্ষকরা ডিউ এর পা ধরে ক্ষমা চেয়ছিরেন বলেও জানা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, আবু সাঈদ হত্যার নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট করার কারণে পুলিশে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছিলেন ডিউ। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্কুলে পুলিশও এসেছিলো।খোঁজ নিয়ে জানা জানা যায়, আফরোজা আক্তার ডিউ কুষ্টিয়া মডেল থানায় দায়েরকৃত প্রতারণাসহ তিন মামলার এজাহার ভুক্ত পলাতক আসামী। ১৮ আগস্ট ২০২৪ ইং তারিখের দায়েরকৃত ১৪ নং মামলা, ২০ আগস্ট ২০২৪ ইং তারিখের দায়েরকৃত ১৮নং মামলা এবং ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ইং তারিখের দায়েরকৃত ২৬নং মামলা।জানতে চাইলে কালেক্টরেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃনাল কান্তি সাহা বলেন, আমরা সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশন করতে ইতিমধ্যে ইউজিসি (বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন) তে চিঠি পাঠিয়েছি। সেখান থেকে জবাব আসলে আমরা পরবর্তি পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
আফরোজা আক্তার ডিউ সম্পর্কে আরো খবর নিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ডিউ কুষ্টিয়া জেলা ক্রিড়া সংস্থা এবং পুনক সহ বিভিন্ন সংগঠনের পদ-পদবী হাতিয়ে নিয়ে রাতারাতি আরো প্রভাবশীল হয়ে ওঠেন। সেই সুবাদে জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিদের সাথে গড়ে তোলেন বিশেষ সখ্যতা। জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তাদের তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজের সিদ্ধির জন্যও ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।জেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারণে সে এবং তার স্বামী জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বিল্পব কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন কর্যালয়ের ভিতরে নিজেদের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন একাধিক জায়গা। যেখানে গড়ে তুলেছে আরশীনগর নামের প্রিন্টিং প্রেস সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান।
যদিও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সেই সকল বরাদ্দ ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। তবে সরেজমিনের গিয়ে দেখা গেছে, আরশীনগর নামের প্রিন্টিং প্রেসের সাইন বোর্ড ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আরশীনগর প্রিন্টিং প্রেসের সকল সরঞ্জাম এখন পর্যন্ত স্ব-স্ব স্থানেই রয়েছে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, বরাদ্দের শর্ত মোতাবেক প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দেওয়ার থাকলেও আফরোজা আক্তার ডিউ ও তার স্বামী রাশেদুল ইসলাম বিল্পব তা দীর্ঘ দিন ধরে পরিশোধ করেননি। আর দীর্ঘ দিনের বকেয়া উত্তোলনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি আজ পর্যন্ত।আফরোজা আক্তার ডিউ এর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত সমস্ত অভিযোগের বিষয়ে তার কোন বক্তব্য বা মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি।মুঠোফোনে এই বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আবদুল ওয়াদুদ জানান, এই বিষয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা হয়েছে। আমরা অতি দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ গ্রহন করবো।